দশম অধ্যায়
অবতার ও আদর্শ জীবনচরিত
অবতরণ করেন যিনি তিনিই অবতার। তবে ধর্মশাস্ত্রে যে-কাউকেই অবতার বলা হয়নি। ভগবান বিষ্ণু যখন জগতের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন রূপে বৈকুণ্ঠ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, তখন তাঁকে বলা হয় অবতার। কাজ শেষ হলে তিনি আবার স্বস্থানে ফিরে যান। বিষ্ণু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছেন। সে-সবের মধ্যে মৎস্যাদি দশ অবতার বিখ্যাত । এ সম্পর্কে আমরা নিচের ক্লাসে জেনেছি। এ অধ্যায়ে আমরা অবতারের ধরন এবং শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে আবির্ভাবের কারণ জানতে পারব ।
অবতার ছাড়াও যুগে-যুগে এমন কিছু মনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যাঁরা আজীবন মানুষের কল্যাণ করে গেছেন । তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। অকাতরে তাঁরা মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সে-সব মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারীদের জীবনই আমাদের নিকট আদর্শ জীবনচরিত। নিচের ক্লাসে আমরা বেশ কয়েকজন মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারীর জীবনী পড়েছি। এখানে আমরা আরো কয়েকজনের জীবনী পড়ব এবং তাঁদের জীবনী থেকে অনেক কিছু শিখতে পারব ।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
পাঠ ১ : অবতার
আগেই বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণু যখন বিভিন্ন রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, তখন তাঁকে বলা হয় অবতার। অবতাররূপে তিনি জগতের কল্যাণ করেন । পৃথিবী সব সময় এক রকম থাকে না। পৃথিবীতে নানা সময়ে নানা দুষ্ট লোকের জন্ম হয় । তারা মানুষের প্রতি অত্যাচার করে । এতে জগতে শোক, দুঃখ, কষ্ট ও অশান্তির সৃষ্টি হয় । শিষ্টদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে । এমনি সময়েই ভগবান বিষ্ণু অবতাররূপে আবির্ভূত হন । দুষ্টদের বিনাশ করেন । জগতে আবার শান্তি ফিরে আসে । ভগবানও তাঁর স্বস্থানে ফিরে যান ।
ভগবান বিষ্ণু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জীবের রূপ ধরে অবতরণ করেন । তিনি যখন মানুষরূপে আবির্ভূত হন, তখন তিনি মানুষের মতোই আচরণ করেন । মানুষের মতোই মাতৃগর্ভে জন্ম নেন । মানুষের মতোই সুখ- দুঃখ ভোগ করেন । তবে তার মধ্য দিয়েও তাঁর কিছু স্বাতন্ত্র্য থাকে । যেহেতু তিনি ভগবান । ভগবান ও মানুষ কখনো এক হতে পারে না ।
অবতারের ধরন
অবতার দুই রকমের পূর্ণাবতার ও অংশাবতার । ভগবান যখন পূর্ণরূপে অবতরণ করেন, তখন তাঁকে বলা হয় পূর্ণাবতার । ভগবানের সমস্ত শক্তি ও গুণ পূর্ণাবতারের মধ্যে থাকে । শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবানের পূর্ণাবতার । কারণ ভগবানের সমস্ত ঐশ্বর্য তাঁর মধ্যে ছিল ।
ভগবানের অপূর্ণাঙ্গের অবতারকে বলা হয় অংশাবতার । অংশাবতারে ভগবানের সমস্ত শক্তি ও গুণ থাকে না । অংশাবতার অনেক । তার মধ্যে দশটি প্রধান, যেমন- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি । এঁরা বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়ে জগতের কল্যাণ সাধন করেছেন । ভগবানের অবতাররূপে শ্রীকৃষ্ণ কেন আবির্ভূত হয়েছিলেন, সে-কথা তিনি নিজেই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলেছেন:
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ । ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। (৪/৭-৮)
হে অর্জুন, জগতে যখন ধর্মের গ্লানি দেখা দেয় এবং অধর্মের উত্থান ঘটে, তখনই আমি নিজেকে সৃজন করি । সজ্জনদের রক্ষার জন্য, দুর্জনদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মকে সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে আমি আবির্ভূত হই । অর্থাৎ অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করি ।
শ্রীকৃষ্ণ যখন আবির্ভূত হন তখন কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল, দুর্যোধন খুবই অত্যাচারী হয়ে
উঠেছিলেন । এদের অত্যাচারে মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছিল । শ্রীকৃষ্ণ এদের বিনাশ করে শান্তি স্থাপন করেন ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছেন । দুষ্টের কাছে তিনি ভয়ঙ্কর, সজ্জনের কাছে শান্তির সৌম্য কান্তিধারী, ভক্তের কাছে ভগবান ।
আদর্শ জীবনচরিত
পাঠ ২ : সুশ্ৰুত
সুশ্রুত প্রাচীন ভারতের একজন মহান চিকিৎসক ছিলেন । তাঁর পিতার নাম বিশ্বামিত্র মুনি ।
দেবরাজ ইন্দ্র একদিন মর্তবাসীকে ব্যাধিগ্রস্ত দেখে দেববৈদ্য ধন্বন্তরীকে সমগ্র আয়ুর্বেদ শিক্ষা দেন এবং বলেন পৃথিবীতে জন্ম নিতে। ইন্দ্রের কথামতো ধন্বন্তরী কাশীরাজের পুত্ররূপে দিবোদাস নামে জন্মগ্রহণ করেন । এ-কথা জানতে পেরে বিশ্বামিত্র স্বীয় পুত্র সুশ্রুতকে তাঁর নিকট পাঠান আয়ুর্বেদ শিক্ষার জন্য । সুশ্রুত দিবোদাসের নিকট আয়ুর্বেদ শিখে চিকিৎসা সংক্রান্ত একখানা গ্রন্থ রচনা করেন । তাঁর নাম অনুসারে গ্রন্থের নাম হয় 'সুশ্রুত' বা 'সুশ্ৰুতসংহিতা' ।
আধুনিক গবেষকদের মতে সুশ্রুত খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে বর্তমান ছিলেন । তনি বর্তমান বারাণসী নগরে গঙ্গার তীরে বাস করতেন এবং চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা করতেন। তিনি প্রধানত শল্যবিদ্যার চর্চা করতেন। এজন্য তাঁকে বলা হয় ‘ভারতীয় শল্যবিদ্যার জনক' । তিনি তাঁর গ্রন্থে শল্যবিদ্যার ৩০০ প্রকার পদ্ধতি এবং ১২০টি অস্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন । পাশ্চাত্ত্যে এই অস্ত্রগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়েছে ।
সুশ্ৰুতসংহিতা প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত - সূত্রস্থান, শারীরস্থান, চিকিৎসিতস্থান এবং কল্পস্থান। এতে আয়ুর্বেদের উৎপত্তি, শল্যতন্ত্র, রসায়নতন্ত্র, পীড়া, ঔষধ, অস্থি, চিকিৎসা, রোগের লক্ষণ, পথ্যাপথ্য ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে । আয়ুর্বেদমতে চিকিৎসা করতে হলে সুশ্রুতসংহিতায় বিশেষ জ্ঞান থাকতে হয় । বর্তমান কালেও চিকিৎসা জগতে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে হলে সুশ্রুতসংহিতায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন । সুশ্রুতসংহিতা রচনা করে সুশ্রুত মানব জাতির বিশেষ মঙ্গল সাধন করেছেন ।
পাঠ ৩ : চরক
চরকও ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন মহান চিকিৎসক । তাঁকে 'ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক' বলা হয় । তাঁর সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু যখন মৎস্যাবতাররূপে আবির্ভূত হন, তখন অনন্তদেব অথর্ববেদের অন্তর্গত আয়ুর্বেদ লাভ করেন। এরপর তিনি মানুষের অবস্থা দেখার জন্য পৃথিবীতে আগমন করেন । দেখেন, অনেকেই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে বেদনায় কাতর। তা দেখে তিনি ভীষণ কষ্ট পান । তাই মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য তিনি একজন মুনিপুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন । চররূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন বলে তাঁর নাম হয় চরক । আধুনিক গবেষকদের মতে চরক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে আবির্ভূত হন ।
চরক মানুষের চিকিৎসা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি একজন সুচিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন । তাঁর পূর্বে আত্রেয়, অগ্নিবেশ প্রমুখ আরো চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরা বৈদ্যক বা চিকিৎসা গ্রন্থও রচনা করেছিলেন । চরক সে সবের সংস্কার ও সারাংশ গ্রহণ করে একখানা নতুন গ্রন্থ প্রণয়ন করেন । তার
নাম ‘চরকসংহিতা' । প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ । গ্রন্থটি আটটি ভাগে বিভক্ত – সূত্রস্থান, নিদানস্থান, বিমানস্থান, শারীরস্থান, ইন্দ্রিয়স্থান, চিকিৎসাস্থান, কল্পস্থান ও সিদ্ধিস্থান ।
চরকই প্রথম মানব দেহের পরিপাক, বিপাক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে বলেন । তিনি শরীরের কার্যকারিতার জন্য তিনটি 'দোষ' বা উপাদানের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো - বাত, পিত্ত ও কফ । এই তিনটির সামঞ্জস্য নষ্ট হলে শরীর অসুস্থ হয় । আর সামঞ্জস্য ফিরে এলে শরীর সুস্থ হয়। চরক এ-ও বলেছেন— রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা বেশি জরুরি। তিনি রোগীর চিকিৎসার পূর্বে রোগের কারণসমূহ এবং পরিবেশ সম্পর্কে যথার্থরূপে ভাবতে বলেছেন ।
চরক প্রজনন বিদ্যা সম্পর্কে জানতেন । এমনকি শিশুর লিঙ্গ নির্ণয়ের কারণসমূহও তিনি জানতেন । মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল । তিনি মানব দেহে দাঁতসহ ৩৬০টি অস্থির কথা বলেছেন । হৃৎপিণ্ডকে বলেছেন দেহের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র । ১৩টি পথে এ কেন্দ্র সমগ্র শরীরের সঙ্গে যুক্ত
বর্তমান কালেও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এ গ্রন্থের গুরুত্ব অনেক । চরকসংহিতা রচনা করে চরক সমগ্র মানব
জাতির বিশেষ মঙ্গল সাধন করেছেন ।
সুশ্রুতসংহিতা এবং চরকসংহিতা উভয় গ্রন্থই ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আব্বাসীর সময় আরবি ভাষায় অনূদিত হয় এবং এর মাধ্যমে ইউরোপে প্রচারিত হয়। এর ফলে ইউরোপের অনেক চিকিৎসক ভারতবর্ষে এসে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন ।
পাঠ ৪ ও ৫ : শ্রীশঙ্করাচার্য
দাক্ষিণাত্যের কেরল রাজ্যে কালাড়ি নামে এক গ্রাম । এই গ্রামে ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের বৈশাখী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে শঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বিশিষ্টা দেবী । শিবগুরু ছিলেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং শিবভক্ত।
শঙ্করের ছিল অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি । তা দেখে পিতা শিবগুরু অত্যন্ত বিস্মিত হন। তিনি তিন বছর বয়স থেকেই পুত্রকে পড়াতে শুরু করেন। তাঁর একান্ত বাসনা, পুত্রকে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত করে তুলবেন । কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয় । তারপর পাঁচ বছর বয়সে বিশিষ্টা দেবী ছেলের উপনয়ন দেন । উপনয়নের পর শাস্ত্রশিক্ষার জন্য তাঁকে গুরুগৃহে পাঠানো হয় । সেখানে মাত্র দুই বছরের মধ্যে শঙ্কর বেদ, বেদান্ত, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । সাত বছর বয়সে বাড়ি ফিরে আসেন । বাড়ি ফিরে তিনি একটি টোল খুলে ছাত্র পড়াতে শুরু করেন। স্থানীয় পণ্ডিতরা প্রথমে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে লাগলেন । সাত বছরের বালক কী পড়াবে? কিন্তু ক্রমে শঙ্করের পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে সবাই তাঁর নিকট মাথা নত করেন ।
শঙ্করের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । এক সময় কেরলের রাজা চন্দ্রশেখরের কানেও যায় এ- কথা । তিনি মন্ত্রীকে পাঠান শঙ্করকে রাজসভায় নিয়ে যেতে । কিন্তু শঙ্কর বিনয়ের সঙ্গে বলেন, তিনি বিদ্যা নিয়ে ব্যবসা করতে চান না। লোকের মঙ্গলের জন্য তিনি বিদ্যা বিতরণ করবেন। বালক শঙ্করের এই তেজোদৃপ্ত কথা শুনে রাজা বিস্মিত হন । তিনি নিজে চলে আসেন শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে । তাঁর সঙ্গে
কথা বলে রাজা তাঁর পাণ্ডিত্যের গভীরতা বুঝতে পারেন । তাই রাজা হয়েও এই অসাধারণ বালক পণ্ডিতকে প্রণাম করে তিনি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দান করেন। কিন্তু শঙ্কর তার একটিও স্পর্শ করেন নি। সব দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন ।
শঙ্করের পাণ্ডিত্যের কথা শুনে একদিন কয়েকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁর বাড়িতে আসেন । তাঁরা শঙ্করের সঙ্গে
বিভিন্ন শাস্ত্রালাপ করে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে মা বিশিষ্টা দেবী পণ্ডিতদের অনুরোধ করেন শঙ্করের কোষ্ঠী দেখতে । পণ্ডিতরা কোষ্ঠী দেখে বলেন, শঙ্করের আয়ু খুবই স্বল্প। ষোল অথবা বত্রিশ বছরে তাঁর মৃত্যুর যোগ আছে । এ-কথা শুনে বিশিষ্টা দেবী কান্নায় ভেঙে পড়েন । তাঁর একমাত্র অবলম্বন শঙ্করকে এত অল্প বয়সে হারাতে হবে।
শঙ্করও এ-কথা শুনলেন। তিনি মাকে খুব ভালোবাসতেন। টোলের ছাত্রদের পড়ানোর অবসরে যে সময়টুকু পেতেন, তখন তিনি কেবল মায়ের সেবা করতেন। কিন্তু মৃত্যুর কথা শুনে তাঁর ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন আসে । জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তিনি নতুন করে ভাবতে লাগলেন । তিনি ভাবলেন, মোক্ষলাভই মানুষের চরম লক্ষ্য । তাই ব্রহ্ম-সাধনায় তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন ।
একদিন শঙ্কর মাকে তাঁর মনের কথা খুলে বলেন। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হন না । অবশেষে শঙ্কর অনেক বুঝিয়ে মাকে রাজি করালেন। তিনি এ-ও বললেন, যেখানেই থাকেন-না-কেন, মায়ের অস্তিম সময়ে তিনি পাশে উপস্থিত থাকবেন । এই বলে শঙ্কর একদিন
গৃহত্যাগ করেন ।
শঙ্কর সন্ন্যাস নেবেন । তাই গুরুর সন্ধান করছেন। দুই মাস ক্রমাগত পথ চলতে চলতে তিনি উপস্থিত হন ওঙ্কারনাথের দ্বীপশৈলে। সেখানে দেখা পান মহাযোগী গোবিন্দপাদের। তাঁর নিকট তিনি সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নেন। তিন বছর গুরুর কাছে থেকে তিনি যোগসিদ্ধি তত্ত্বজ্ঞান আয়ত্ত করেন। তারপর গুরুর নির্দেশে চলে যান হিমালয়ের নিভৃত ধাম বদরিকা আশ্রমে । সেখানে তিনি বেদান্তভাষ্য প্রভৃতি গ্রন্থ রচনায়
মনোনিবেশ করেন। ষোল বছর বয়সের মধ্যেই তিনি গুরুর নির্দেশিত গ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন ।
এর পর ধর্মগুরু হিসেবে শুরু হয় শঙ্করের নতুন জীবন । তাঁর অনেক শিষ্যও জুটে যায় । তিনি তখন আচার্য নামে খ্যাত । শঙ্করাচার্য । বদরিকাশ্রম থেকে তিনি পুণ্যধাম বারাণসীতে আসেন । সেখানে ধর্ম প্রচার শুরু করেন । তাঁর ধর্মের মূল কথা ‘অদ্বৈতবাদ' । তিনি বলেন, 'ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা । জীব ও ব্রহ্মে কোনো পার্থক্য নেই ।'
শঙ্করের এই মতবাদ প্রথমে অনেকেই মানতে চান নি । কিন্তু তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতার কাছে সবাই হার মানেন । তাঁর মতবাদ মেনে নেন । তিনি একে একে কুমারিল ভট্ট, মণ্ডন মিশ্র প্রভৃতি বিখ্যাত পণ্ডিতদের শাস্ত্র বিচারে পরাজিত করেন ।
শঙ্কর তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ান। তিনি ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন । দ্বারকায় সারদা মঠ, পুরীতে গোবর্ধন মঠ, জ্যোতির্ধামে (বদরিকাশ্রমে) যোশী মঠ এবং রামেশ্বরে শৃঙ্গেরী মঠ । এই মঠ পরিচালনার জন্য তাঁর চারজন শিষ্যকে দায়িত্ব অর্পণ করেন । তাঁরা হলেন যথাক্রমে সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, তোটকাচার্য ও হস্তামলকাচার্য। শঙ্করাচার্য বিভিন্ন দলীয় সন্ন্যাসীদের এই সব মঠে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন । এটা তাঁর একটি উজ্জ্বল কীর্তি ।
শঙ্করাচার্য যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবন যেমন বিপর্যস্ত ছিল, ধর্মীয় জীবনও তেমনি বিপর্যস্ত ছিল । জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে নানা কুসংস্কার ঢুকে পড়েছিল । হিন্দুধর্মও ম্লান হয়ে পড়েছিল । সমাজে বেদের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞের প্রাধান্য বেড়ে গিয়েছিল । শঙ্করাচার্য তাঁর অদ্বৈতমত প্রচার করে হিন্দুধর্মের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন । জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কেনো পার্থক্য নেই - এ- কথা বলে তিনি মানুষের প্রতি মানুষের, এমনকি জীবের প্রতিও মানুষের ভালোবাসাকে জাগিয়ে তোলেন । এর ফলে জীবহিংসা কমে যায় । এটা শঙ্করাচার্যের একটা বড় অবদান । শুধু তা-ই নয়, তিনি যে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য ও বেদান্তভাষ্য রচনা করেছেন তা হিন্দু ধর্ম ও দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ অবদান । এছাড়া তিনি সাধারণ মানুষের জন্য মোহমুদগর, আনন্দলহরী, শিবস্তব, গোবিন্দাষ্টক প্রভৃতি গ্রন্থও রচনা করে গেছেন । মাত্র ৩২ বছর বয়সে এত অসাধারণ কাজ করে আচার্য শঙ্কর উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে ইহলীলা সংবরণ করেন । তার আগে অবশ্য তিনি মায়ের অন্তিম শয্যায় উপস্থিত ছিলেন, যেহেতু তিনি মাকে কথা দিয়েছিলেন ।
শঙ্করাচার্যের মোহমুদ্গর কাব্য থেকে কয়েকটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ নিম্নে দেয়া হলো:
১. কে তব কান্তা আর কে তব কুমার ?
অতীব বিচিত্র এই মায়ার সংসার ।
কোথা হতে আসিয়াছ, তুমি বা কাহার,
ভাব করহ ভাই, এই তত্ত্ব সার ।
২. পদ্মপত্রে বারিবিন্দু যেমন চঞ্চল,
জীবন তেমন হয় অতীব চপল ।
অবতার ও আদর্শ জীবনচরিত
জানিও করেছে গ্রাস ব্যাধি বিষধর,
সমস্ত সংসার তাই শোকে জরজর ।
৩. দিবস যামিনী আর সায়াহ্ন প্রভাত,
শিশির বসস্তু পুনঃ করে যাতায়াত ।
এই রূপে খেলে কাল ক্ষয় পায় আয়ু,
তথাপি মানব নাহি ছাড়ে আশা-বায়ু ।
৪. যতদিন করে নর ধন উপার্জন,
ততদিন থাকে বশে নিজ পরিজন ।
পরে যবে বৃদ্ধ কালে জীর্ণ হয় দেহ,
ডেকেও জিজ্ঞাসা ঘরে নাহি করে কেহ ।
পাঠ ৬ ও ৭ : প্রভু নিত্যানন্দ
১৪৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একচক্রা গ্রামে প্রভু নিত্যানন্দ জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম হাড়াই পণ্ডিত এবং মাতার নাম পদ্মাবতী । হাড়াই পণ্ডিত ছিলেন একজন সৎ ব্রাহ্মণ । পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি এবং যজন যাজনের কাজ মিলিয়ে তাঁর সংসারটি ছিল বেশ স্বচ্ছল।
নিত্যানন্দের প্রকৃত নাম ছিল কুবের। গ্রামের পাঠশালায় পিতা তাঁর বাল্যশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি মেধাবী ছিলেন । কিন্তু পড়াশোনায় তাঁর একদম মন ছিল না। তার চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি । ধর্মকথা শুনতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলা করতেন বটে, তবে খেলার পরিবর্তে কোনো মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতে তাঁর বেশি ভালো লাগত । তাঁর এই ধর্মানুরাগের মূলে ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ । কুবের শুধু শ্রীকৃষ্ণের কথাই ভাবতেন। কীভাবে তাঁকে পাওয়া যায় – এই ছিল তাঁর সারাক্ষণের ভাবনা । কোনো সাধু সন্ন্যাসীকে দেখলেই তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যাবে। কী করলে
কুবেরের বয়স তখন বারো বছর। একদিন এক সন্ন্যাসী এলেন তাঁদের গাঁয়ে । উঠলেন তাঁদেরই বাড়ি । তিনি বৃন্দাবনে যাবেন । কুবের শুনেছেন বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের শীলাক্ষেত্র। তাই তিনি ভাবলেন, বৃন্দাবন
গেলে হয়তো তাঁর প্রাণের ঠাকুর কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে। কুবের সন্ন্যাসীকে তাঁর মনের কথা বললেন । সন্ন্যাসী বললেন, ‘এত অল্প বয়সে সন্ন্যাস নেয়া ঠিক নয় । তাছাড়া সন্ন্যাস নিতে হলে পিতা-মাতার সম্মতি লাগে ।'
কিন্তু কুবের নাছোড়বান্দা। তিনি বৃন্দাবনে যাবেনই। অগত্যা পিতা-মাতার সম্মতি নিয়ে তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন । অনেক অরণ্য, পাহাড়-পর্বত, তীর্থস্থান ঘুরে বেড়াতে লাগলেন । বছরের পর বছর কেটে গেল । হঠাৎ একদিন কুবের সন্ন্যাসীকে হারিয়ে ফেললেন । তারপর তিনি একাই বিভিন্ন তীর্থ পর্যটন করতে লাগলেন। এভাবে একদিন উপস্থিত হলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৃন্দাবনে। এখানে এসে কৃষ্ণদর্শনের জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল । তিনি পাগলের ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ।
একদিন তাঁর সাক্ষাৎ হয় পরম সন্ন্যাসী শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে । তাঁর কাছে তিনি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন । গুরুর সঙ্গে কিছুদিন বৃন্দাবনে থেকে কুবের আবার বেরিয়ে পড়েন তীর্থ পর্যটনে । একা একা বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়ান । এ সময় তিনি রামেশ্বর, নীলাচল, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন । কিন্তু কৃষ্ণবিরহের ব্যাকুলতা তাঁর ক্রমশই বাড়তে থাকে । তাঁর একটাই চিন্তা – কৃষ্ণদর্শন কীভাবে হবে । তাই তিনি আবার বৃন্দাবনে ফিরে এলেন ।
কুবের সর্বদা কৃষ্ণচিন্তায় বিভোর থাকেন । কীভাবে কখন কৃষ্ণদর্শন হবে এই তাঁর একমাত্র ভাবনা । এই ভাবনায় তাঁর দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল । হঠাৎ একদিন তিনি কৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখেন। কৃষ্ণ তাঁকে বলছেন, 'তুমি গৌড় দেশে নবদ্বীপে যাও। সেখানে নিমাই পণ্ডিত আচণ্ডালে প্রেমভক্তি প্রচার করছেন । তাঁর সঙ্গে যোগ দাও ।' উল্লেখ্য যে, এই নিমাই পণ্ডিতই শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্য নামে পরিচিত ।
এভাবে স্বপ্নে কৃষ্ণদর্শন হওয়ায় কুবেরের মন অনেকটা শান্ত হয় । স্বপ্নে হলেও তিনি শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেছেন । তাই তাঁর আদেশে তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে নবদ্বীপের পথে রওনা হলেন । নবদ্বীপে নন্দন আচার্যের গৃহে নিমাইয়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় । দুজন দুজনকে চিনতে পারেন, বুঝতে পারেন। তাঁরা দুয়ে মিলে যেন এক । জীবোদ্ধারের জন্য যেন দুই দেহে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে। সেদিন থেকে কুবেরের নতুন নাম হলো নিত্যানন্দ । সংক্ষেপে নিতাই । আর গৌরাঙ্গের সংক্ষিপ্ত নাম গৌর । ভক্তরা সংক্ষেপে বলতেন গৌর-নিতাই ।
গৌর-নিতাই দুজনে নবদ্বীপে প্রেমভক্তি প্রচার করতে লাগলেন । নেচে-গেয়ে তাঁরা হরিনাম বিলাতে লাগলেন । তাঁদের প্রেমধর্মে কোনো জাতিভেদ নেই । উঁচু-নীচু নেই । তখন সমাজে শুষ্ক ধর্মাচরণ প্রবল হয়ে উঠেছিল । মানবপ্রেম তার নীচে চাপা পড়েছিল । তাই প্রেমভক্তি দিয়ে গৌর-নিতাই সমাজের সবাইকে কাছে টেনে নিলেন । ফলে দলে-দলে লোক তাঁদের অনুসারী হলো ।
কিন্তু বৈষ্ণববিদ্বেষীরা গৌর-নিতাইয়ের এই প্রেমধর্ম প্রচারে বাধা দিতে লাগলেন। কখনো কখনো তাঁদের ওপর আক্রমণও চালান ।
তখন নবদ্বীপে জগন্নাথ ও মাধব নামে দুই ভাই নগর কোতোয়ালের কাজ করতেন । লোকে তাঁদের বলত জগাই- মাধাই । তাঁরা ছিলেন মদ্যপ এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতির । যখন যা খুশি তা-ই করতেন । কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করত না । নিত্যানন্দ এ-কথা জানতে পারলেন । তিনি শ্রীগৌরাঙ্গকে বললেন, ‘জগাই-মাধাইকে উদ্ধার করতে হবে ।' প্রভু মৌন সম্মতি দিলেন ।
তারপর একদিন নিত্যানন্দ ও হরিদাস কৃষ্ণনাম করতে করতে পথ দিয়ে ফিরছেন। হঠাৎ জগাই-মাধাইয়ের সঙ্গে তাঁদের দেখা । মদ খেয়ে তখন তাঁরা মাতাল । কৃষ্ণনাম শুনে তাঁরা ক্রোধে ফেটে পড়লেন । মাধাই একটা ভাঙ্গা কলসির কানা ছুঁড়ে মারলেন নিতাইয়ের দিকে । মাথায় লেগে কেটে গেল । দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল । কিন্তু নিত্যানন্দ এক হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরে কৃষ্ণনাম গেয়েই চললেন। এতে মাধাই আরো ক্ষেপে গিয়ে আবার নিতাইকে মারতে গেলেন । কিন্তু জগাই তাঁকে আটকালেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন পথচারী সেখানে জড় হয়েছেন। নিতাইয়ের অবস্থা দেখে তাঁদের মায়া হলো । কিন্তু জগাই-মাধাইয়ের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলল না ।
ঘটনাটি শ্রীগৈারাঙ্গের কানেও গেল । সঙ্গে-সঙ্গে তিনি দল-বল নিয়ে ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে । তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে । জগাই-মাধাইকে তিনি কঠোর দণ্ড দেবেন। নিত্যানন্দ তখন এগিয়ে এসে বললেন, ‘প্রভু, জগাইয়ের কোনো দোষ নেই । সে আমাকে রক্ষা করেছে । মাধাইও ভুল করে এ-কাজ করেছে। তুমি এদের ক্ষমা করে দাও।'
নিত্যানন্দের কথা শুনে গৌরাঙ্গ অনেকটা শান্ত হলেন । তিনি এগিয়ে গিয়ে জগাইকে বুকে টেনে নিলেন । তা দেখে মাধাইয়ের মনে অনুশোচনা এল । তিনি এগিয়ে এসে বললেন, 'প্রভু, আমি অপরাধ করেছি । আমায় ক্ষমা করে দাও ।' গৌরাঙ্গ বললেন, “নিতাই যদি তোমায় ক্ষমা করে তাহলে তুমি ক্ষমা পাবে।' এরপর মাধাই জোড়হাতে এগিয়ে গেলেন নিত্যানন্দের দিকে । নিত্যানন্দ তাঁকে বুকে টেনে নিলেন। এভাবে গৌর-নিতাই তাঁদের প্রেমভক্তি দিয়ে জগাই-মাধাইকে উদ্ধার করলেন । উপস্থিত লোকজন সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল । এভাবে গৌর-নিতাই নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম কীর্তন ও প্রেমভক্তি দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে লাগলেন । মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কমতে লাগল । এমন সময় একদিন শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে গেলেন । নিত্যানন্দও সঙ্গে গেলেন । সেখানে কিছুদিন থাকার পর গৌরাঙ্গ একদিন বললেন, 'নিত্যানন্দ, গৌড়ে এখন একদিকে চলছে শক্তি বা তন্ত্রসাধনা, অন্যদিকে চলছে নব্যন্যায়ের যুক্তিসর্বস্ব জ্ঞানতত্ত্বচর্চা । ধর্মপিপাসু সাধারণ মানুষ কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেনা । তুমি সেখানে গিয়ে সংসারী হও এবং বিদ্বান, মূর্খ, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, ধনী, দরিদ্র সকলের মধ্যে হরিভক্তি ও প্রেমধর্ম বিতরণ কর। সকলকে এক কৃষ্ণনামে আবদ্ধ কর।'
একথা শুনে নিত্যানন্দের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো । তাকে প্রভুর সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু প্রভুর আদেশ । মানতেই হবে । তাই নিত্যানন্দ গৌড়ে ফিরে এলেন এবং কালনার অধিবাসী সূর্যদাসের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবীকে বিবাহ করেন । তাঁদের নিয়ে তিনি খড়দহে সংসার পাতেন। বসুধার পুত্র বীরভদ্র । জাহ্নবীর কোনো সন্তান না থাকায় তিনি এক পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন । তাঁর নাম রামাই গোস্বামী । খড়দহের গোস্বামীরা এঁদেরই বংশধর । নিত্যানন্দ ধারার গোস্বামীরা গৌড়দেশের সমাজজীবনে বেশ কিছুকাল ধরে প্রেমধর্মের প্রসার ঘটান।
গৌরাঙ্গের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে নিত্যানন্দ গৌড়রাজ্যে, বিশেষত নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম ও প্রেমধর্ম প্রচার করতে লাগলেন । কৃষ্ণনামের পাশাপাশি তিনি কীর্তন করতেন:
ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম । যে ভজে গৌরাঙ্গ চাঁদ, সে হয় আমার প্রাণ ।
এভাবে তিনি কৃষ্ণনামের সঙ্গে একীভূত করে দেন শ্রীগৌরাঙ্গের নাম । গৌরাঙ্গ-প্রবর্তিত প্রেমধর্মের এক মহাপ্রচারকরূপে গৌড়দেশে আবির্ভূত হন নিত্যানন্দ । ধর্মতত্ত্বের কোনো বিচার-বিশ্লেষণ বা তর্ক-বিতর্ক নেই, আচার-অনুষ্ঠানের কোনো বাড়াবাড়ি নেই, শুধু আচণ্ডালে প্রেম বিতরণ আর কৃষ্ণনামগান । এভাবে প্রেমভক্তি আর কৃষ্ণনাম প্রচারের মাধ্যমে তিনি অনেক পাপী-তাপীকে উদ্ধার করেছেন । সকলকে কৃষ্ণভক্তরূপে ভালোবেসেছেন । তাঁর এই জীবোদ্ধারের কথা সারা গৌড়ে ছড়িয়ে পড়ে । দলে-দলে লোকজন তাঁর কাছে ছুটে আসতে থাকে । এর ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ জীবনে এক বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। সকলে সমস্ত রকম ভেদাভেদ ভুলে এক সারিতে এসে দাঁড়ায়। সার্থক হয় শ্রীগৌরাঙ্গের প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণনামের আন্দোলন । নিত্যানন্দও চির অমর হয়ে থাকেন গৌড়বাসীর অন্তরে। ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে এই মহাসাধক ইহলীলা সংবরণ করেন।
পাঠ ৮ : মীরাবাঈ
ভারতের রাজস্থানে কুড়কি নামে একটি গ্রাম । এই গ্রামে ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাঠোর বংশে মীরাবাঈ জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা রত্নসিংহ ছিলেন মেড়তার অধিপতি রাও দুধাজীর পুত্র। মা বীর কুঁয়রী ছিলেন ঝালাবংশীয় রাজপুত্র শূরতান সিংহের কন্যা। রত্নসিংহ কুড়কি অঞ্চলে বারোখানা গ্রামের জায়গির পেয়ে সেখানেই গড় নির্মাণ করে বাস করতেন ।
মীরা ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান । তাই খুব আদর-যত্নে তিনি লালিত-পালিত হচ্ছিলেন । কিন্তু মাত্র আট বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান । ফলে তাঁর জীবনে একটা ছন্দপতন ঘটে। পিতা রত্নসিংহ মেয়েকে নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েন। তখন পিতামহ রাও দুধাজী মীরাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। পরম যত্নে তাঁকে লালন-পালন করতে থাকেন ।
দুধাজী নিজে ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ । মেড়তার প্রাসাদের পাশে ছিল তাঁরই প্রতিষ্ঠিত চতুর্ভুজজীর মন্দির । তিনি নিয়মিত সেখানে পূজার্চনা করতেন। মাঝে মাঝে মীরাও সেখানে যেতেন । মন্দিরের পুরোহিত গদাধর পণ্ডিত শাস্ত্রালোচনা করতেন । মীরা আগ্রহভরে তা শুনতেন । পিতামহ দুধাজীও মাঝে মাঝে তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি শোনাতেন ।
এর ফলে ছোটবেলা থেকেই ধর্মজীবনের একটা আদর্শ মীরার হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে যায়। বালিকা বয়সেই মীরা ভক্তিরসাত্মক ভজন রচনায় অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দেন। চতুর্ভুজজীর মন্দিরের দেয়ালে মীরার কয়েকটি উৎকৃষ্ট ভজন উৎকীর্ণ আছে ।
একবার এক সাধু মীরাকে গিরিধারী গোপালের একটি বিগ্রহ দেন। মীরা সেটি প্রাসাদে নিয়ে নিত্য তার সেবা-পূজা করতেন। এর ফলে ছোটবেলা থেকেই কৃষ্ণের প্রতি মীরার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয় ।
মীরা যৌবনে পা দিয়েছেন। রূপলাবণ্যে তিনি অনন্যা । পিতামহ দুধাজী নাতনির বিবাহ ঠিক করলেন । পাত্র চিতোরের রাণা সংগ্রামসিংহের পুত্র ভোজরাজ । ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে মহাসমারোহে মীরার বিবাহ হয়ে গেল । তিনি চলে গেলেন শ্বশুর বাড়ি ।
শ্বশুর বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব নেই । রাণা সংগ্রামসিংহের মতো শ্বশুর। ভোজরাজের মতো সুযোগ্য স্বামী । অতুল ঐশ্বর্য । অসংখ্য দাস-দাসী । কিন্তু এ-সবের প্রতি মীরার কেনো আসক্তি নেই । জীবনে তাঁর একমাত্র কাম্য বস্তু হলো কৃষ্ণপ্রেম আর গিরিধারীলালের সাক্ষাৎ লাভ। তিনি শুধু সাধন-ভজন নিয়েই থাকেন । প্রাসাদে কোনো সাধু-সন্ত এলে ছুটে যেতেন তাঁর কাছে। একমনে হরিকথা শুনতেন। কখনো কখনো ভাবাবিষ্ট হয়ে নিজের কণ্ঠেই শুরু করতেন ভজন গান । তাঁর কণ্ঠ এত মধুর ছিল যে সবাই মন দিয়ে তা শুনত ।
ভোজরাজ স্ত্রীর প্রতি ছিলেন উদার ও সহনশীল। তিনি স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে পারেন । তাই একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণ করে সেখানে কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করে দেন । মীরা এতে খুব খুশি হন । স্বামীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি বেড়ে যায় । কিন্তু সময় কাটে তাঁর কৃষ্ণভজনে । সংসারের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই । এতে আত্মীয়-পরিজন ও প্রাসাদের লোকজনের মধ্যে নিন্দা ও সমালোচনা শুরু হয়ে যায় ।
ক্রমশ মীরার মধ্যে কৃষ্ণপ্রেমের ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায় । রাজবধূর বেশে তিনি যেন এক সর্বত্যাগিনী তপস্বিনী । দিনে রাতে প্রায় সময়ই তিনি ভজন-পূজনে ব্যস্ত থাকেন । ইষ্টদেব গোপীনাথের জন্য মাঝে মাঝে কাঁদতে থাকেন । এরূপ অবস্থায় ভোজরাজ একদিন স্ত্রীকে ডেকে বলেন – তোমার প্রাণের বেদনা কোথায়, প্রাণের আকুতি কী তা খুলে বল । বল, তুমি কী চাও । কী পেলে তুমি সুখী হবে, কিসে শান্তি লাভ করবে তা আমায় বল ।
মীরা তখন মধুর কণ্ঠে একটি ভজন গেয়ে তার উত্তর দিলেন:
মেরে ত গিরিধর গোপাল, দুসরো ন কোই জাঁতে শির মোর মুকুট মেরে পতি সোই ।
অর্থাৎ গিরিধারী গোপাল ছাড়া আমার কেউ নেই । যাঁর মাথায় ময়ূর-মুকুট তিনিই আমার পতি । ভোজরাজ স্ত্রীর সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হলেন । তাঁর মনের কথাও বুঝতে পারলেন । তিনি মীরার সাধন-ভজনে সার্বিক সহযোগিতা করতে লাগলেন ।
এদিকে রাজবধূ মীরার কৃষ্ণপ্রেমের ব্যাকুলতার কথা চিতোরের সাধারণ মানুষ এবং সাধু-সন্ন্যাসীরা জেনে গেছেন । তাঁরা মীরাকে রাজমহিষী নয়, বরং ভক্তিসাধিকা মীরাবাঈ বলে জানলেন । মীরার সুমধুর কণ্ঠের সঙ্গীত এবং প্রেম সাধনার কথা সমগ্র রাজস্থানেই প্রচারিত হলো ।
এ অবস্থায় ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে ভোজরাজ হঠাৎ মারা যান । এর অল্পকাল পরে শ্বশুর রাণা সংগ্রামসিংহও মারা
যান । তখন চিতোরের নতুন রাণা হন বিক্রমজিৎ সিং । তিনি মীরার ওপর নানা অত্যাচার করতে থাকেন।
তাঁকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করা হয় । কিন্তু তাঁর আরাধ্য গিরিধারীর কৃপায় তিনি রক্ষা পান ।
শেষপর্যন্ত মীরাবাঈ পিতৃগৃহ মেড়তায় ফিরে যান । সেখান থেকে চলে যান বৃন্দাবনে । তখন শ্রীরূপ গোস্বামী গৌড়ীয় বৈষ্ণবমণ্ডলীর আচার্য । মীরা তাঁর দর্শন কামনা করেন । কিন্তু আচার্য স্ত্রীলোককে দর্শন দিতে রাজি নন । তখন মীরা বলেন, ‘গোস্বামীজী কি ভাগবতের কথা বিস্মৃত হয়েছেন? বৃন্দাবনের একমাত্র পুরুষ
শ্রীকৃষ্ণ । আর সকলেই প্রকৃতি । তবে তত্ত্বদর্শী গোস্বামীজী আমাকে দর্শন দিতে এত কুণ্ঠিত কেন?' মীরার তত্ত্বপূর্ণ কথা শুনে শ্রীরূপ গোস্বামী প্রীত হন এবং মীরার সঙ্গে কৃষ্ণকথা বলেন । মীরার কৃষ্ণ- ব্যাকুলতা গোস্বামীকে মুগ্ধ করে ।
বৃন্দাবনে এসে মীরা তীব্রভাবে প্রেমভক্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন। দিকে দিকে তাঁর নাম প্রচারিত হয়।
রাজস্থান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে মীরার নাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় । কৃষ্ণ ভক্তিপরায়ণা মীরাবাঈ ভালোবাসার
মধ্য দিয়ে ভগবান প্রাপ্তির পথ প্রদর্শন করেন । তাঁর রচিত ভজন-সঙ্গীত কৃষ্ণপ্রেমের গান, কৃষ্ণের উপাসনা এবং ভগবৎ সাধনার এক নতুন পথ প্রদর্শন করে । এই সঙ্গীতধারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সৃষ্টি করে । এই সম্প্রীতি যে মিলনধারায় প্রকাশ লাভ করে, তার নাম ‘ভক্তিবাদ' । হিন্দুধর্মের ভাগবতধর্ম ও ভক্তিবাদ এবং ইসলামের সুফীবাদে সকল শ্রেণির মানুষকে সমান চোখে দেখা হয় । অতঃপর একদিন বৃন্দাবনের লীলা সাঙ্গ করে মীরা কৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত দ্বারকার উদ্দেশে যাত্রা করেন । দ্বারকাধামে এসে রণছোড়জীর বিগ্রহের ভজন-পূজনেই জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন । এই দ্বারকাধামেই তাঁর দেহলীলা সংবরণ হয় ।
মীরাবাঈয়ের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, যাঁরা প্রকৃত সাধক তাঁরা জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যান । দৈহিক রূপ-লাবণ্য, পার্থিব বিষয়-আশয়, সুখ-সাচ্ছন্দ্য তাঁদের চিত্তকে আকর্ষণ করে না। সবকিছু ছেড়ে তাঁরা কাম্য বস্তুকে লাভ করার জন্য একাগ্রচিত্তে সাধনা করেন। সে সাধনায় তাঁরা সফলও হন।
পাঠ ১৩ ১০ : শ্রীরামকৃষ্ণ
'সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ', অর্থাৎ ধর্মীয় মত ও পথ ভিন্ন হলেও সকল মানুষের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক – ঈশ্বর লাভ। এই পরম সত্যটি যিনি উপলব্ধি করেছিলেন তিনি প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না । তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী তাঁর জন্ম – ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তাঁর পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবী। পিতা-মাতা বিষ্ণুর অপর নামানুসারে শিশুপুত্রের নাম রাখেন গদাধর। এই গদাধরই পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নামে জগদ্বিখ্যাত হন।
বালক গদাধর দেখতে ছিলেন খুবই সুন্দর এবং প্রকৃতিপ্রেমী । প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কিংবা আকাশে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক দেখে মাঝে মাঝে তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়তেন । এটা ছিল তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু স্কুলের লেখাপড়ায় তাঁর মন ছিল না একেবারেই । তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। একবার কিছু শুনলেই মুখস্থ বলতে পারতেন। এভাবে তিনি পিতার কাছ থেকে শেখেন ধর্মীয় শ্লোক ও স্তব-স্তোত্র, গ্রামের কথকদের কাছ থেকে শেখেন রামায়ণ-মহাভারত এবং পুরীগামী তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে শেখেন ধর্মগীতি । ভজন-কীর্তনের প্রতি তাঁর খুব আকর্ষণ ছিল। এভাবে গদাধর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
গদাধরের অল্প বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যুর হয়। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর জীবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে । তিনি কখনও শ্মশানে গিয়ে বসে থাকেন। কখনও বা নির্জন বাগানে গিয়ে সময় কাটান। সাধু- বৈষ্ণবদের দেখলে কৌতূহল ভরে তাঁদের আচরণ লক্ষ করেন । তাঁদের নিকট ভজন শেখেন । এ অবস্থায় অগ্রজ রামকুমার তাঁকে কোলকাতা নিয়ে যান। সেখানে ঝামাপুকুরে অবস্থিত নিজের টোলে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন । কিন্তু গদাধরের মনের কোনো পরিবর্তন হয় না । আগের মতোই লেখাপড়ায় তিনি উদাসীন থাকেন ।
এমন সময় রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে রামকুমার দক্ষিণেশ্বরে আসেন । গদাধরও তাঁর সঙ্গে আসেন । মা-কালীর বিগ্রহ এবং পূজার্চনা দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হন । তিনি যেন এতদিন এমন একটা কিছুই চেয়েছিলেন । তাই কখনও তিনি মায়ের মন্দিরে ভাবতন্ময় হয়ে থাকেন, কখনও বা আত্মমগ্ন অবস্থায় গঙ্গার তীরে ঘুরে বেড়ান ।
হঠাৎ একদিন অগ্রজ রামকুমারের অকালমৃত্যু হয়। ফলে মায়ের পূজার ভার পড়ে গদাধরের ওপব । মনেপ্রাণে তিনি মায়ের পূজা আরম্ভ করেন । মায়ের পূজায় ভক্তিগীতি গাওয়ার সময় প্রায়ই তিনি অচেতন হয়ে পড়তেন । কালক্রমে এখানেই কালীসাধনায় তাঁর সিদ্ধিলাভ ঘটে । তিনি স্ত্রী সারদা দেবীকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করেন, যা অচিরেই তাঁকে ‘আধ্যাত্মিক জননী' পদে উন্নীত করে। এভাবে গদাধর সর্বত্র চৈতন্যরূপিণী দেবীর দর্শন লাভ করেন ।
১৮৫৫ সনে গদাধর মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত হন । এতে তাঁর কালীসাধনার সুবর্ণ সুযোগ ঘটে । এর ছয় বছর পর ১৮৬১ সালে সিদ্ধা ভৈরবী যোগেশ্বরী দক্ষিণেশ্বরে আসেন। গদাধর তাঁকে গুরু মানেন এবং তান্ত্রিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন । এই ভৈরবীই গদাধরকে অসামান্য যোগী এবং অবতার পুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন ।
এরপর গদাধরের সাধন জীবনে আসেন সন্ন্যাসী তোতাপুরী । তিনি গদাধরকে বেদান্ত সাধনায় দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নাম রাখেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস । শ্রীরামকৃষ্ণ একই সঙ্গে বৈষ্ণব সাধনায়ও সিদ্ধিলাভ করেন ।
রামকৃষ্ণ শুধু হিন্দু ধর্মমতভিত্তিক সাধনায়ই আবদ্ধ থাকেন নি । তিনি ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মমতেও সাধনা করেছেন । এভাবে বিভিন্ন ধর্ম সাধনার মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর মতে সকল ধর্মেই জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা । ধর্মসমূহের পথ ভিন্ন হলেও সকলেরই উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা । তাই তিনি উদার কণ্ঠে বলেছেন, ‘সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ ।' তিনি প্রথাগত সন্ন্যাসীদের মতের সঙ্গে একমত ছিলেন না বা তাঁদের মতো পোশাকও পরতেন না । এমনকি তিনি স্ত্রী সারদা দেবীকে সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে পূজা করতেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন লোকগুরু । ধর্মের জটিল তত্ত্ব তিনি গল্পের মাধ্যমে সহজ করে বোঝাতেন । ঈশ্বর রয়েছেন সকল জীবের মধ্যে, তাই জীবসেবাই ঈশ্বরসেবা – এই ছিল তাঁর দর্শন । ধর্মীয় সম্প্রীতিতে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন তিনি । তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁরই ধর্মীয় আদর্শ জগদ্বাসীকে শুনিয়ে গেছেন, যার ফলে তাঁর এই জীবসেবার আদর্শ অর্থাৎ মানবধর্ম আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত । বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেব সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি যেদিন জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে । এখন থেকে সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন ।'
শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধন-দর্শনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । ফলে অনেক জ্ঞানী-গুণী দক্ষিণেশ্বরে আসতে থাকেন । তাঁর উদার ধর্মীয় নীতির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবাদর্শে মোহগ্রস্ত অনেক শিক্ষিত যুবক ভারতীয় আদর্শে ফিরে আসেন । তিনি যেমন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে যেতেন, তেমনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গও তাঁর নিকট আসতেন । শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র সেন, মহেন্দ্রনাথ সরকার, গিরিশচন্দ্র ঘোষসহ আরো অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন । ফরাসি মনীষী রমারলাঁ বিবেকানন্দের কাছ থেকে শুনে এতটাই প্রভাবিত হন যে, তিনি রামকৃষ্ণ সম্পর্কে এক বৃহদাকার গ্রন্থ রচনা করেন ।
পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী শুধু মুখের কথা নয়, সেগুলো তাঁর জীবনচর্চায় রূপায়িত সত্য। তিনি অহংকারশূন্য হয়ে জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা করেছেন । দরিদ্রদের দেখলে তাঁর মন কাঁদত। একবার তিনি তীর্থ দর্শনে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবু। তাঁরা তখন দেওঘরে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মনে খুব ব্যথা পেলেন । তিনি মথুরবাবুকে বললেন দরিদ্রনারায়ণের সেবার ব্যবস্থা করতে । মথুরবাবু তাই করলেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর সাধক । কালীমূর্তিতে তিনি পুজো দিতেন । এর মধ্য দিয়েই তিনি মায়ের সাধনা করতেন । তাই বলে মূর্তিপূজার বিরোধী ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না। ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক। কেশবচন্দ্রই প্রথম তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা এবং তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার মাধ্যমে রামকৃষ্ণদেবের কথা প্রচার করেন । এ থেকেই বোঝা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ কতটা পরমতসহিষ্ণু ছিলেন । তাঁর সাধন-প্রণালী এবং ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে সর্বধর্ম সমন্বয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে । এটা শ্রীরামকৃষ্ণের একটা বড় অবদান ।
শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের জাতি, কুল, মান, শিক্ষা, প্রতিপত্তি ইত্যাদি দেখতেন না । তিনি দেখতেন মানুষের অন্তর । তাই তাঁর কাছে উঁচু-নীচু সব শ্রেণির মানুষ আসত । তাইতো দক্ষিণেশ্বর মন্দির ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত ।
শ্রীরামকৃষ্ণ সকল নারীর মধ্যে জগন্মাতাকে দর্শন করতেন । নারীমাত্রই তাঁর কাছে ছিল মাতৃস্বরূপা ।
তাইতো নিজের স্ত্রীকেও তিনি মাতৃজ্ঞানে পুজো করেছিলেন । জগতে এরূপ ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই । শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘যখন বাইরে লোকের সঙ্গে মিশবে, তখন সকলকে ভালোবাসবে । মিশে যেন এক হয়ে যাবে । বিদ্বেষভাব রাখবে না । ও সাকার মানে, নিরাকার মানে না; ও নিরাকার মানে, সাকার মানে না; ও হিন্দু, ও মুসলমান, ও খ্রিষ্টান – এই বলে কাউকে ঘৃণা করবে না ।'
শ্রীরামকৃষ্ণের এই যে উদার মনোভাব, এর দ্বারা ভারতের লোকজন দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন । ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে তাঁর কাছে এসেছেন । তাঁর অমৃত বাণী শ্রবণ করেছেন । অন্তরে পরম শান্তি পেয়েছেন । শুধু ভারতীয়রাই নন, শ্রীরামকৃষ্ণের উদার ধর্মমত দ্বারা বিদেশিরাও বিমোহিত হয়েছেন। এক রাশিয়ান অধ্যাপক ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত' (গস্পেল অফ শ্রীরামকৃষ্ণ) পড়ে বলেছেন, ‘এত উদার, এত বিশ্বজনীন, সর্বজনীন ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।' একজন ইহুদি বলেছেন, ‘ইজরাইলে একটি রামকৃষ্ণ সেন্টার হওয়া উচিত ।' একজন আফ্রিকান বলেছেন, তিনিও তাঁর দেশে একটি রামকৃষ্ণ বেদান্ত সেন্টার খুলতে চান ।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট এই মহাপুরুষ পরলোক গমন করেন। তাঁর সাধনাস্থান দক্ষিণেশ্বর এখন অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত ।
শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকটি উপদেশ
১. পিতাকে ভক্তি কর, পিতার সঙ্গে প্রীতি কর। জগৎরূপে যিনি সর্বব্যাপী হয়ে আছেন, তিনিই মা । জননী, জন্মস্থান, বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে যে ধর্ম করবে, তার ধর্ম ছাই হয়ে যাবে ।
২. মা গুরুজন, ব্রহ্মময়ী-স্বরূপা । যতক্ষণ মা আছে, মাকে দেখতে হবে ।
৩. ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয় । অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ হয়, পবিত্র হয়। একমাত্র ভক্তির দ্বারা জাতিভেদ উঠে যেতে পারে । ভক্তের জাতি নেই । ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা সব শুদ্ধ হয় । ভক্তি না থাকলে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয় । ভক্তি থাকলে চণ্ডাল চণ্ডাল নয় । ভক্ত হলে চণ্ডালের অন্নও খাওয়া যায়।
৪. ছাদের উপর উঠতে হলে মই, বাঁশ, সিঁড়ি ইত্যাদি নানা উপায়ে যেমন ওঠা যায়, তেমনি
এক ঈশ্বরের কাছে যাবার অনেক উপায় আছে । প্রত্যেক ধর্মই এক একটি উপায় । প্রত্যেক ধর্মই সত্য ।
৫. আন্তরিক হলে সব ধর্মের ভেতর দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় । ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে
পৌঁছানো যায় । ‘যত মত তত পথ' ।
৬. পিঁপড়ের মতো সংসারে থাক। এই সংসারে নিত্য-অনিত্য মিশে আছে। বালিতে-চিনিতে
মেশানো । পিঁপড়ে হয়ে চিনিটুকু নেবে ।
৭. জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নেই । কিন্তু নৌকার ভেতরে যেন জল না ঢোকে । তাহলে নৌকা ডুবে
যাবে ।
৮. ঈশ্বর এক, তাঁর অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাব । যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভালো লাগে,
সে সেই নামে ও সেই ভাবে ডাকলে দেখা যায় ।
৯. ভক্তেরা তাঁকেই নানা নামে ডাকছে; এক ব্যক্তিকেই ডাকছে। এক পুকুরের চারটি ঘাট । হিন্দুরা জল নিচ্ছে একঘাটে, বলছে জল; মুসলমানরা আর একঘাটে নিচ্ছে, বলছে পানি; ইংরেজরা আর একঘাটে নিচ্ছে, বলছে ওয়াটার; আবার অন্য লোক একঘাটে নিচ্ছে, বলছে Aqua । এক ঈশ্বর তাঁর নানা নাম ।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী থেকে আমরা এই নীতিশিক্ষা পাই যে, ঈশ্বরজ্ঞানে জীবের সেবা করতে হবে । পিতা, মাতা এবং জন্মভূমিকে শ্রদ্ধা করতে হবে । সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে । তাহলে আর ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেবে না। সকল ধর্মেরই লক্ষ্য এক — ঈশ্বরলাভ । এতে জাতিভেদ থাকবে না। ভক্তের কোনো জাতি নেই। ঈশ্বরের বহু নাম। ভক্তিভরে যে-কোনো নামে ডাকলেই তাঁকে পাওয়া যায়। সকল ধর্মে ভক্তি থাকলে ভক্তিতে দেহ, মন, আত্মা শুদ্ধ হয় । দরিদ্র নারায়ণ, তার সেবা করতে হবে । এতে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন ।
আমরা সকলে শ্রীরামকৃষ্ণের এই নীতিশিক্ষা অনুসরণ করব । তাহলে আমরা যথার্থ মানুষ হতে পারব ।
পাঠ ১১ : শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
বাংলা ১২৪৮ সালের (১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দ) শ্রাবণ মাস। তখন ছিল পূর্ণিমা তিথি । নবদ্বীপের শান্তিপুরে প্রতি বৈষ্ণব মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা উৎসব পালিত হচ্ছে। সেই উৎসবমুখর পুণ্য তিথিতে ভোর বেলায় বিজয়কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন । পিতা আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান ভক্ত । মা স্বর্ণময়ী দেবীও ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ দয়াবতী রমণী ।
অবতার ও আদর্শ জীবনচরিত
বিজয়কৃষ্ণ গ্রামের পাঠশালা করেন। তারপর ভর্তি হন শান্তিপুর টোলে। সেখানের পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হল কোলকাতার সংস্কৃত কলেজে। এ সময় তাঁর বিয়ে হয় । স্ত্রী যোগমায়া ছিলেন শিকারপুরের রামচন্দ্র দুীর কন্যা ।
সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল পড়ার পর বিজয়কৃষ্ণ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে করেন । সবার সিদ্ধাन বন্ধুকে নিয়ে বলে বুঝবেন, তিনি তা প্রাণপণে কার্যে পরিণত করবেন। এই সভায় বিজয়কৃষ্ণ এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেন। তিনি বলেন, পৈতা জাতিভেদের চিহ্ন। ভাই আমাদের পৈতা ত্যাগ করা উচিত। এ-কথা যারা ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁরা সবাই পৈতা ফেলে দেশ । সেই সমরে ব্রাহ্মণ হরে পৈতা ফেলে এক ছিল ।
এই সময় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বিষয়কৃষ্ণের যোগাযোগ ঘটে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা সে তাঁর মনে পরিবর্তন আসে। তিনি ব্রাহ্মর প্রি অনুরক্ত হন এবং ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন ।
বিকৃষ্ণের এই পৈতা ও ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা ভালো চোখে দেখেন নি । বিজয়কৃষ্ণ এ-সময় শান্তিপুরে এলে তাঁর প্রতি তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মত ও বিশ্বাসের ব্যাপারে আপোষ করেন নি। তিনি কোলকাতা চলে আসেন।
তখন বিকৃষ্ণের মেডিকেলের চূড়ান্ত পরীক্ষা সামনে। তিনি ত হচ্ছেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ থেকে রাক্ষ এল ধর্ম প্রচারের । চিকিৎষ্যতের কথা চিন্তা না করে বিষয় ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দায়িত্ব এবণ করেন । তিনি হলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বিজয়কৃষ্ণ । ঢাকা, বরিশাল, যশোর, খুলনা এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করেন। অনেককে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দেন ।
বিজয়কৃষ্ণ এক সময় উত্তরাঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। তখন তিনি এক কঠিন অসুখে পড়েন। সেবার বারদীয় শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর কৃপার তিনি সুস্থ হন। এ ঘটনা তাঁর জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলে।
বাবা লোকনাথ এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রভাবে তাঁর মধ্যে আবার বৈষ্ণব ভাব জেগে ওঠে । এ-সময় গয়ার আকাশ গঙ্গা পাহাড়ে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যোগী ব্রহ্মানন্দ স্বামীর সঙ্গে । তিনি তাঁকে দীক্ষা দিয়ে পুনরায় হিন্দু যোগীতে পরিণত করেন । এরপর বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্মধর্ম ছেড়ে দেন ।
এ-সময় বিজয়কৃষ্ণ স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং শিষ্যদের নিয়ে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়েন। তখন লোকনাথ বাবার নির্দেশে তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আশ্রম স্থাপন করে নামগান ও হরিসংকীর্তন করতে থাকেন । এতে তাঁর
অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ঢাকায় তাঁর যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ।
বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় আশ্রম স্থাপন করলেও মাঝে মাঝেই তনি কোলকাতা যেতেন । একবার স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বৃন্দাবনে যান । সেখানে কলেরা রোগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় । তারপর ১৩০৪ সালের (১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) ফাল্গুন মাসে বিজয়কৃষ্ণ শ্রীক্ষেত্র পুরী চলে যান । সেখানে অতি অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন । উড়িষ্যা প্রদেশেও তাঁর প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে । এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্থানীয় ধর্মব্যবসায়ীরা একদিন তাঁকে বিষ মিশ্রিত লাড্ডু খেতে দেয়। তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৩০৬ সালের (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) ২২এ জ্যৈষ্ঠ রবিবার ইহলোক ত্যাগ করেন ।
বিজয়কৃষ্ণের কয়েকটি উপদেশ
১. হরিনামে প্রেম লাভের আটটি ক্রম
ক. পাপবোধ
খ. পাপকর্মে অনুতাপ
গ. পাপে অপ্রবৃত্তি ঙ. সাধুসঙ্গে অনুরাগ
ঘ. কুসঙ্গে ঘৃণা
চ. নামে রুচি ও গ্রাম্য কথায় অরুচি
ছ. ভাবোদয়
জ. প্ৰেম ।
২. অন্তরে হিংসা থাকলে ঈশ্বরের লীলা দর্শন হয় না । যদি কিছু সময়ের জন্যও হৃদয় হিংসাশূন্য হয়,
তখন লীলা দর্শন হতে পারে ।
৩ । কখনো পরনিন্দা করবে না ।
৪ । সত্য কথা বলবে ও সর্বদা ব্রহ্মচর্য রক্ষা করবে ।
৫ । সর্বদা নিষ্ঠাসহকারে ভগবানের নাম করবে ।
৬। সর্বজীবে দয়া করবে ।
৭ । বৃথা অহংকার করবে না ।
৮ । শাস্ত্র ও মহাজনদের বিশ্বাস করবে ।
পাঠ ১২, ১৩ ও ১৪ : স্বামী বিবেকানন্দ
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।
জীবের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, ঈশ্বরজ্ঞানে জীবসেবার এমন কথা আর কে কবে বলেছেন? বলেছেন একজনই । এই অমর বাণীর সেই প্রবক্তা হচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ । ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কোলকাতায় তাঁর জন্ম। পিতা বিশ্বনাথ ছিলেন কোলকাতা দত্ত হাইকোর্টের একজন বিখ্যাত উকিল এবং মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন সুগৃহিণী ।
বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী । বিশেষ করে দর্শনশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল । তিনি যখন জেনারেল এ্যাসেম্বলি কলেজ(বর্তমানে স্কটিস চার্চ কলেজ)-এর ছাত্র, তখন কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেষ্টি এক বিতর্কসভায় নরেন্দ্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, জার্মান বা ইংলন্ডের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মতো কোনো ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
নরেন্দ্রনাথ ১৮৮৪ সনে বিএ পাশ করেন। তার আগেই তাঁর মধ্যে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে চিন্তা করেন । ঈশ্বর কি আছেন? তাঁকে কি দেখা যায়? এ ধরনের প্রশ্ন তাঁর মনকে আন্দোলিত করে । তিনি অনেককে এ প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু কারো উত্তর তাঁর মনঃপুত হয়নি। এমন সময় একদিন তাঁর দেখা হয় কালীর সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ তখন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে থাকেন। নরেন্দ্রনাথ একদিন চলে যান সেখানে। রামকৃষ্ণকে তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন ? রামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলেন, 'হ্যাঁ, দেখেছি; যেমন তোকে দেখছি । চাইলে তোকেও দেখাতে পারি । এই সাদাসিধে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণকে নরেন্দ্রনাথের ভালো লাগে। তাঁর প্রতি একটা ভক্তির ভাব জেগে ওঠে । শ্রীরামকৃষ্ণও নরেন্দ্রনাথকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হন । তিনি যেন এতদিন তাঁরই অপেক্ষা ছিলেন । নরেন্দ্রনাথ নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন । এক সময় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নেন । নরেন্দ্রনাথ হন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। তখন তাঁর নাম হয় বিবেকানন্দ। পরবর্তীকালে ভক্তরা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ বা শুধু স্বামীজী বলেই ডাকতেন ।
বিবেকানন্দ গৃহত্যাগ করে সারা ভারতবর্ষ ঘুরলেন । নিজের চোখে ভারতবাসীর দুরবস্থা দেখলেন । কীভাবে এ থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করা যায়, সে-কথাও চিন্তা করতে লাগলেন । তারপর এক সময় কন্যাকুমারীকায় ভারতের শেষ শিলাখণ্ডে বসে তিনি ধ্যানস্থ হলেন। ঐ শিলাখণ্ডের নাম এখন 'বিবেকানন্দ শিলা ।’ ধ্যানের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারলেন, ভারতের জীবনীশক্তির উৎস হচ্ছে ধর্ম । এই ধর্ম হচ্ছে দেবতাজ্ঞানে মানবসেবা । এই ধর্মমন্ত্রে ভারতবাসীদের জাগিয়ে তুলতে হবে । তিনি আরো বুঝতে পারলেন, বৈরাগ্য ও সেবাধর্ম হচ্ছে ভারতীয়দের জাতীয় আদর্শ এবং এ পথেই তাদের জাতীয় শক্তিকে পরিচালিত করতে হবে । তবেই ভারতের উন্নতি হবে ।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বিবেকানন্দ আমেরিকা যান এবং শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতা দেন । তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘হিন্দুধর্ম পৃথিবীর সকল ধর্মকে সমান সত্য মনে করে । সব ধর্মেরই লক্ষ্য এক। নদীসমূহ যেমন এক সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সকল ধর্মেরই লক্ষ্য এক-ঈশ্বরলাভ । তাই বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি ।' তিনি আরো বলেন, “খ্রিষ্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না; অথবা হিন্দু বা বৌদ্ধকে খ্রিষ্টান হতে হবে না; কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই অন্যান্য ধর্মের সারভাগগুলি গ্রহণ করে পুষ্টিলাভ করবে এবং নিজস্ব বিশেষত্ব বজায় রেখে নিজ প্রকৃতি অনুসারে বিকাশলাভ করবে ।' বিবেকানন্দের এই বক্তৃতায় সবাই মুগ্ধ হন । ধর্মসভার বিচারে তিনি হন শ্রেষ্ঠ বক্তা । আমেরিকার নিউইয়র্ক হেরাল্ড' পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা শোনবার পর মনে হবে ভারতের মত জ্ঞানৈশ্বর্যমণ্ডিত দেশে আমাদের দেশের ধর্মপ্রচারক পাঠানো নির্বুদ্ধিতার কাজ ।
ধর্মসভায় বক্তৃতার পর সারা আমেরিকায় বিবেকানন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্ৰণ আসে বক্তৃতার জন্য । তিনিও হিন্দু ধর্ম-দর্শন, বিশেষত বেদান্ত দর্শন ও মানবধর্ম সম্পর্কে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেন । সেখানকার সংবাদপত্রগুলিতে তাঁকে ‘সাইক্লোনিক হিন্দু' নামে অভিহিত করা হয় । বিবেকানন্দ তাঁর মতাদর্শ প্রচারের জন্য নিউইয়র্কে ‘বেদান্ত সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন । এরপর তিনি যান ইউরোপ । ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশে একের পর এক বক্তৃতা দেন । তিনি বেদান্ত দর্শনের প্রকৃত সত্য তুলে ধরেন । বেদান্তের মূল কথা হলো – ‘জীব ও ব্রহ্মে কোনো পার্থক্য নেই; জীবই ব্ৰহ্ম ।' তাই ব্ৰহ্মজ্ঞানে জীবসেবা করতে হবে । তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে এ সত্যও প্রতিষ্ঠিত করেন যে, হিন্দুধর্ম কেবল মূর্তির পূজা করে না, সকল দেবতার পূজার মধ্য দিয়ে এক ঈশ্বরেরই আরাধনা করে । তাঁর বক্তৃতা থেকে পাশ্চাত্যের মানুষ হিন্দু ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে নতুন করে জানতে পারেন। অনেকে তাঁর পরম ভক্ত হয়ে যান । তাঁদের মধ্যে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিবেকানন্দের আদর্শে এতটাই উদ্বুদ্ধ হন যে, নিজের জন্মভূমি আয়ারল্যান্ড ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন । বিবেকানন্দের কাছে তিনি দীক্ষা নেন । তখন তাঁর নাম হয় ভগিনী নিবেদিতা ।
প্রায় চার বছর পর বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন । দেশের মানুষ তাঁকে বিশাল সম্বর্ধনা দেয় । তার উত্তরে তিনি সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে বলেন। সমস্ত কুসংস্কার পরিত্যাগ করতে বলেন । সবাইকে বিভেদ ভুলে এক হতে বলেন । তিনি বলেন, ‘শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম । দুর্বলতা ও
কাপুরুষতাই পাপ । স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ । পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ । আত্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরে বিশ্বাস – এ-দুটি জিনিসই উন্নতি লাভের একমাত্র উপায় ।'
বিবেকানন্দ বলতেন, সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি । সৎ হওয়া আর সৎ কর্ম করা ধর্মের অঙ্গ । তিনি অথর্ববেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘অসত্য নয়, সত্যেরই জয় হয়; একমাত্র সত্যের মধ্য দিয়েই ঈশ্বর লাভের পথ প্রসারিত হয় ।' যে ব্যক্তি জগতের জন্য তার ক্ষুদ্র 'আমিকে' ত্যাগ করতে পারে, সে দেখে সমস্ত জগৎ তার । যে ব্যক্তি পবিত্র এবং সাহসী, সেই সব কিছু করতে পারে ।
বিবেকানন্দের কাছে কোনো জাতিভেদ ছিল না । তিনি বলতেন – নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর সকলেই আমাদের ভাই । এদের সেবাই পরম ধর্ম। তাঁর এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ যুবকরা পর্যন্ত কলেরাপীড়িত চণ্ডালদের পাশে বসে তাদের সেবা করেছেন । বিবেকানন্দের মৃত্যুর দশ বছর পরে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রচনাবলি পড়ে অনুভব করতে পারেন যে, মানবসেবাই হচ্ছে মুক্তির একমাত্র পথ । তাই নিঃস্বার্থ সেবাকেই তিনি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র করেন এবং পরবর্তীকালে ‘নেতাজি' ভূষণে ভূষিত হন ।
বিবেকানন্দ নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন । নারীশিক্ষাকে তিনি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করতেন। বৈদিক যুগের মৈত্রেয়ী, গার্গী প্রমুখ বিদুষী নারীর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন –সেই যুগে নারীরা যদি এত শিক্ষালাভ করতে পারে, তাহলে এযুগের নারীরা পারবে না কেন? তাঁর মতে যে-জাতি নারীদের সম্মান দেয় না, সে-জাতি কখনো বড় হতে পারে না । 'নারীদের অবস্থার উন্নতি না করে বিশ্বের মঙ্গলসাধন করা সম্ভব নয় । কোন পাখি একটি ডানা নিয়ে উড়তে পারে না।' এমনকি অধ্যাত্ম সাধনায় নারীরা যাতে সুযোগ পায় এবং এগিয়ে আসে তার জন্য তিনি সারদাদেবীর পরিচালনায় নারীদের জন্য একটি মঠ প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ দেশের উন্নতির জন্য সমাজ সংস্কারের কথাও ভাবতেন । তিনি বলতেন – দেশের উন্নতি করতে হলে সব স্তরের মানুষের উন্নয়ন প্রয়োজন । তিনি সমাজের নীচু স্তরের মানুষদের প্রতি উঁচু স্তরের মানুষের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন । সারা দেশ ঘুরে তিনি শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অবস্থা দেখেছেন । তাঁদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এক সময় এঁরাই ভারতবর্ষ শাসন করবেন । তাই তিনি বলেছেন, '.... নূতন ভারত বেরুক । বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে । বেরুক ঝোপ জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে ।
বিবেকানন্দ অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয় । তাই তিনি বলতেন –দেশের জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, তবেই একটি উন্নত জাতি গড়ে তোলা
সম্ভব হবে । শিক্ষার ব্যাপারে স্বামীজীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সবাই যাতে সমান শিক্ষা পায়। তাই তিনি বলতেন— ব্রাহ্মণের ছেলের যদি একজন শিক্ষকের দরকার হয়, তাহলে শূদ্রের ছেলের দুজন বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষকের প্রয়োজন । তিনি চাইতেন – ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণই থাকুক, তবে ব্রাহ্মণ যেন চেষ্টা করেন শূদ্রকেও তাঁর নিজের পর্যায়ে তুলে আনতে । নিজে মানুষ হওয়া এবং অন্যকেও প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করা – এটিই হওয়া উচিত মানব জীবনের উদ্দেশ্য ।
সমাজের দরিদ্রদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিবেকানন্দ অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছিলেন । তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন – দরিদ্ররা যদি স্কুলে না আসতে পারে তাহলে শিক্ষাকেই - তাদের কাছে পৌছে দিতে হবে, কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে যেখানে তারা কাজ করে সেখানে । তিনি আরো বলেছেন, ‘সামর্থ্য না থাকলে একটি কুঁড়ে ঘর বানাও । সেখানে গরিব লোকেরা সাহায্য নিতে ও উপাসনা করতে আসবে । সেই মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা ধর্মকথা ও পুরাণকথা পাঠ হবে । এর মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি শিক্ষা দেবে।'
স্বামীজী বুঝতে পেরেছিলেন যে, খালি পেটে ধর্ম হয় না । তাই তিনি বলেছেন, ‘অন্ন চাই! অন্ন চাই! দরিদ্রের মুখে অন্ন জোগাতে হবে। আগে অন্ন, তারপর ধর্ম । যারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে তাদের আমরা ধর্মোপদেশ শুনিয়ে যাচ্ছি । ধর্মমতবাদে কি পেট ভরে? সব কিছুরই প্রথম অংশ পাবে দরিদ্র। আমাদের অধিকার শুধু অবশিষ্টাংশে । দরিদ্ররা ঈশ্বরের প্রতিভূ; যেই লাঞ্ছনা ভোগ করে সেই ঈশ্বরের প্রতিভূ। দরিদ্রকে না দিয়ে যে আহারে আনন্দ পায় সে পাপে আনন্দ পায়।'
১৮৯৭ সনে বাংলার কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। বিবেকানন্দ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন । আলমোড়া থেকে ভগিনী নিবেদিতাকে এক পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার কিছু ছেলেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত জেলাগুলিতে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছি। এটা ইন্দ্রজালের মত কাজ করছে । আমি যা ভেবেছিলাম তাই দেখছি । দেখছি একমাত্র হৃদয়ের মধ্য দিয়ে জগতের কাছে পৌঁছানো যায়।'
বিবেকানন্দ সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য রাজা রামমোহন রায়ের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন । বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগরকে মহাবীর বলে আখ্যায়িত করেন । তবে বিধবাদের পুনর্বিবাহের পাশাপাশি তাদের যথাযথ শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার কথাও বলেন। বাল্যবিবাহকে তিনি ঘৃণা করতেন । তিনি বলেছেন, ‘বাল্যবিবাহে মেয়েরা অকালে সন্তান প্রসব করে অধিকাংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের সন্তানসন্ততি ক্ষীণজীবী হয়ে দেশে ভিখারির সংখ্যা বৃদ্ধি করে । ... লেখাপড়া শিখিয়ে একটু বয়স হলে বে দিলে সেই মেয়েদের যে সন্তানসন্ততি জন্মাবে, তাদের দ্বারা দেশের কল্যাণ হবে।' শুধু তা-ই নয়, তিনি বলেছেন, 'ইচ্ছা না থাকলে বিবাহ না করার স্বাধীনতা সকল স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক অধিকার বলে গণ্য হওয়া উচিত ।'
এভাবে স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কার এবং দেশের উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন । তিনি অন্য সন্ন্যাসীদের মতো কেবল ঈশ্বর-সাধনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন নি। তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও এমনটাই চেয়েছিলেন ।
বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেবের আদর্শ প্রচারের জন্য ১৮৯৭ সনে ‘রামকৃষ্ণ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর একটি মঠও প্রতিষ্ঠা করেন । পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বেলুড়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে এটি অবস্থিত । সাধারণভাবে এটি ‘বেলুড় মঠ' নামে পরিচিত । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা রয়েছে । এসবের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠ । বাংলাদেশে যেসব মঠ ও মিশন রয়েছে, সেসবের প্রধান কেন্দ্র ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন । পৃথিবী ব্যাপী এই মঠ ও মিশনের মাধ্যমে ধর্ম চর্চার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষকে সেবা প্রদান করা হচ্ছে । সেবার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, আপৎকালীন সাহায্য প্রদান ইত্যাদি ।
বিবেকানন্দের বিপুল অধ্যাত্মশক্তি ও কর্মব্রতের মধ্য দিয়ে ভারতের আত্মা সেদিন জেগে উঠেছিল । দেশের ধর্মক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে জেগেছিল এক নতুন প্রাণস্পন্দন। আত্মবিস্মৃত জাতি সেদিন দেশের সনাতন ধর্মজীবন থেকে প্রাণরস আহরণে প্রবৃত্ত হয়ে উঠেছিল । ভারতের অন্তর্নিহিত ঐক্যবোধ জাতীয় জীবনে আত্মপ্রকাশ করেছিল ।
বিবেকানন্দ ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। কাজ ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। তাই বিশ্রামের অভাবে অল্পদিনেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে । ফলে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই বেলুড় মঠে এই মহামনীষী দেহ ত্যাগ করেন । বিবেকানন্দের কয়েকটি বাণী
১ । ধর্ম এমন একটি ভাব যা পশুকে মানুষে এবং মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে ।
২ । ওঠ, জাগো, আর ঘুমিয়ো না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজেদের ভেতর রয়েছে এ- কথা বিশ্বাস কর, তাহলেই শক্তি জেগে উঠবে । 1
৩ । অপরকে ভালোবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ । ৪ । যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারা যায়, সে-ই হচ্ছে শিক্ষা ।
৫ । হৃদয় ও মস্তিষ্ক দ্বারাই চিরকাল যা কিছু বড় কাজ হয়েছে, টাকার দ্বারা নয় ।
৬। ভেবো না তোমরা দরিদ্র, ভেবো না তোমরা বন্ধুহীন; কে কোথায় দেখেছে – টাকায় মানুষ করেছে! মানুষই চিরকাল টাকা করে থাকে । জগতের যা কিছু উন্নতি, সব মানুষের শক্তিতে হয়েছে, উৎসাহের শক্তিতে হয়েছে, বিশ্বাসের শক্তিতে হয়েছে। প্রাচীন ধর্ম বলত, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে সে
নাস্তিক । নতুন ধর্ম বলছে, যে আপনাতে বিশ্বাস না করে সে-ই নাস্তিক ।
৭ । বিশ্বাসই হলো মানবসমাজ ও সব ধর্মের সবচেয়ে বড় শক্তি ।
৮ । জীবসেবার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই । ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।'
বিবেকানন্দের জীবনী থেকে আমরা এই নীতিশিক্ষা পাই যে, পৃথিবীর সকল মানুষ এক জাতি। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই । ধর্ম তাদের পৃথক পৃথক হতে পারে । তবে সব ধর্মেরই ভিত্তি এক এবং তা হলো সত্য । সত্যই ধর্ম । জীবসেবা মানেই ঈশ্বরসেবা । মানুষকে ধর্মের কথা বলার আগে তার দারিদ্র্য দূর করতে হবে । কারণ খালি পেটে কেউ ধর্মের কথা শুনতে চায় না । ধনী-দরিদ্র, মুচি-মেথরে কোনো পার্থক্য নেই । সবাই ভাই-ভাই । কোনো মানুষই অস্পৃশ্য নয়, পেশা তার যা-ই হোক। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকলকেই শিক্ষিত করে তুলতে হবে । প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত জাগতিক বা পারমার্থিক উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয় । আত্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরে বিশ্বাস উন্নতির প্রথম শর্ত ।
বিবেকানন্দের এই শিক্ষা আমরা সর্বদা হৃদয়ে ধারণ করব । প্রতিটি কাজে-কর্মে এর প্রতিফলন ঘটাব । তাহলে আমরাও জীবনে সফল হতে পারব ।
পাঠ ১৫ ও ১৬ : শ্রীমা
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১এ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিস শহরে শ্রীমা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীরা । ভারতের পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দ আশ্রমে এসে তাঁর নাম হয় শ্রীমা। ভক্তরা তাঁকে এ নামেই ডাকতেন । ভারতবাসীর কাছে তিনি এই নামেই পরিচিত।
শৈশবকাল থেকেই শ্রীমার মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব জেগে ওঠে । তাঁর বয়স যখন মাত্র চার, তখনই তিনি
মাঝে মাঝে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তেন । আর পাঁচজন শিশুর মতো শৈশবেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা
হয়। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। এতে তাঁর বাবা-মা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। শুধু পড়াশোনা নয়, পার্থিব কোনো কিছুর প্রতিই শ্রীমার কোনো আসক্তি ছিল না। তিনি শুধু ঈশ্বর চিন্তা করতেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন ।
প্যারিস শহরের বাইরে ছিল এক প্রকাণ্ড বন । শ্রীমা সময় পেলেই সেখানে গিয়ে গাছতলায় ধ্যানে বসতেন।
তখন পাখিরা নির্ভয়ে এসে তাঁর শরীরে বসত। কাঠবিড়ালীরা ছুটোছুটি করত তাঁর ওপর দিয়ে । এমনিভাবে বনের গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে তাঁর এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে মায়ের বয়স যখন উনিশ বছর, তখন তিনি আলজিরিয়ার ক্লেমসেন শহরে যান । সেখানে তেঁও নামে এক
বিখ্যাত গুণীন থাকতেন । তাঁর কাছ থেকে তিনি হঠযোগ ও অনেক গুপ্তবিদ্যা শিক্ষা করেন ।
দেশে ফিরে শ্রীমা আরো গভীর সাধনায় মগ্ন হন । তিনি উপলব্ধি করেন যে, ঈশ্বর আছেন। তাঁর সঙ্গে মানুষের আত্মিক মিলন সম্ভব । ঈশ্বরকে তিনি সব সময় জ্যোতির্ময়রূপে দেখতে চান । একবার তিনি এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে স্বপ্নে দেখেন । তিনি যেন তাঁকে বলছেন: ওঠ, আরো ওপরে ওঠ । সকলকে ছাড়িয়ে ওপরে ওঠ, কিন্তু সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দাও নিজের আত্মাকে ।
শ্রীমা এবার ভারতীয় দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব পড়তে শুরু করেন । তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, নিরাকার নির্গুণ ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই রূপ পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন । তাই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব স্থান ভারতবর্ষে আসার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে । ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বামী মঁসিয়ে পল রিশারকে নিয়ে চলে আসেন ভারতবর্ষে । ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা ২৯শে মার্চ পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে উপস্থিত হন । সেখানে ঋষি অরবিন্দকে দেখে শ্রীমার স্বপ্নে দেখা সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন বিধিনির্দিষ্ট এক বিশেষ দিব্যকর্ম করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছেন এবং মহাযোগী শ্রীঅরবিন্দের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তিনি উপলব্ধি করলেন, অরবিন্দের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্যেই আছে তাঁর আত্মার মুক্তি । সারা পৃথিবীর মধ্যে পণ্ডিচেরীর আশ্রমকেই তাঁর কাছে স্বর্গ মনে হলো । এই শান্ত তপোবনের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর সকল সাধনার সিদ্ধি, তাঁর আত্মার চূড়ান্ত সার্থকতা। তাই তাঁরা দুজনেই অশ্রমে থেকে গেলেন । শ্রীঅরবিন্দের নিকট দীক্ষা নিলেন । তাঁর সাধন কর্মের সহযোগী হয়ে উঠলেন । তখন আশ্রম থেকে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় ‘আর্য’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো । তাঁরা দুজনেই এই পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে অরবিন্দকে সাহায্য করতে লাগলেন ।
কিন্তু এ যাত্রায় শ্ৰীমা বেশিদিন ভারতে থাকতে পারেন নি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তাঁদের প্যারিসে ফিরে যেতে হলো । এতে মা-র মন খুব আকুল হয়ে ওঠে। শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে পরমাত্মা ও জীবাত্মার বিচ্ছেদের মতো মনে হতে লাগল । তিনি আকুল নয়নে পূর্ব দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ।
এভাবে কেটে গেল প্রায় পাঁচ বছর । ইতিমধ্যে যুদ্ধ থেমে গেছে। হঠাৎ অরবিন্দের কাছ থেকে তিনি আহ্বান পেলেন ভারতবর্ষে আসার । তাঁর মন উদ্বেল হয়ে উঠল । আর বিলম্ব নয় । তিনি যাত্রা করলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪এ এপ্রিল তিনি পণ্ডিচেরীতে পৌঁছান । তাঁর মন শান্ত হলো । এবার গুরুদেবের নির্দেশমতো তিনি নিয়মিত যোগ সাধনা শুরু করে দিলেন । ইউরোপীয় বেশভূষা ত্যাগ করে ভারতীয় যোগিনীর বেশ ধারণ করলেন । তাঁর পরনে তখন দেশি শাড়ি ও ব্লাউজ । খাদ্যদ্রব্যও দেশীয় ।
আমিষের পরিবর্তে নিরামিষ । পরে অবশ্য শ্রীঅরবিন্দের নির্দেশে মা ইউরোপীয় পোশাকও পরতেন । কারণ অরবিন্দ বলতেন, ইন্দ্রিয় ও মনকে জয় করতে পারলে বাইরের পোশাক-পরিচ্ছদে কিছু যায় আসে না ।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪এ নভেম্বর শ্রীঅরবিন্দ পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করেন । সেদিন থেকেই একটি ঘরে তিনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন । ফলে আশ্রমের সমস্ত ভার পড়ে শ্রীমার ওপর । শ্রীমাও সর্বান্তঃকরণে সে ভার গ্রহণ করেন । তিনি পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পদ ও অর্থ পেয়েছিলেন। তা দিয়ে তিনি আশ্রমের খরচ চালাতে লাগলেন । দিনদিন আশ্রমে লোকজন বাড়তে লাগল । শ্রীমাও অতিশয় যোগ্যতার সঙ্গে সকলের ভরণ-পোষণ করে যেতে লাগলেন । কর্মফলের প্রতি সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে তিনি পরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে লাগলেন । খাদ্য, কৃষি, শিল্প, গো-পালন প্রভৃতি বিভাগ খুলে শ্রীমা আশ্রমটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে তুললেন ।
শ্রীমা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আধ্যাত্মিক সাধনা করতে হলে শরীরকে সুস্থ রাখতে হয় । এজন্য যোগব্যায়াম প্রয়োজন । তাই আশ্রমে তিনি একটি ব্যায়ামাগার গড়ে তোলেন ।
শ্রীঅরবিন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমা আশ্রমে একটি ছোট্ট পাঠশালা খোলেন । সেখানে ছেলে-মেয়েরা মনের অনন্দে লেখাপড়া করত । ক্রমে পাঠশালা থেকে বিদ্যালয় ও পরে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় । তার নাম হয় ‘আন্তর্জাতিক শিল্পকেন্দ্র' । এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেয়া হয় । তবে সবাইকে আধ্যাত্মিক ভাবে সমৃদ্ধ করে তোলা হয় । শ্রীমা এখানে ধর্ম ও কলাবিদ্যার এক সার্থক সমন্বয় সাধন করেছিলেন । এখানে বিশ্বের যে-কোনো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে পারে । আশ্রমবাসীদের চিকিৎসার জন্য শ্রীমা একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন । এ হাসপাতালে সকলকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় ।
আশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার সমস্ত ব্যায়ভার আশ্রমই বহন করে । আশ্রমের নিজস্ব জমি, বাগান ও দুগ্ধ খামার আছে । সেসব থেকে চাল, ফলমূল, দুধ ইত্যাদি পাওয়া যায় । অর্থাৎ শ্রীমা সত্যিকার অর্থেই আশ্রমটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন ।
আশ্রমের একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হলো সমস্তরকম ভেদজ্ঞানের বিলোপ । আশ্রমে যাঁরা থাকেন তাঁদের সকলকেই কাজ করতে হয় । ছোট-বড় কাজে কোনো পার্থক্য নেই । যে-কেউ যে-কোনো কাজ করেন । ধর্মীয় গোঁড়ামি বলতে কিছু নেই । মা চাইতেন আশ্রমবাসীরা ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে সকল ধর্ম সম্পর্কে উদার ও শ্রদ্ধাশীল হোক । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই শিক্ষা নিয়ে আশ্রমের আদর্শ সর্বত্র ছড়িয়ে দিক ।
আশ্রমের সকলকে মা সন্তানের ন্যায় ভালোবাসতেন । নিজের মায়ের মতোই তিনি সকলের সুখ-সুবিধার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন । শুধু তা-ই নয়, আশ্রমের বৃক্ষ-লতা ও পশু-পাখির প্রতিও মায়ের গভীর ভালোবাসা ছিল । আশ্রমে নতুন অতিথি এলে মা সকলকে বুঝিয়ে দিতেন, কেউ যেন এদের প্রতি অসম্মান না করেন। কেউ যেন গাছের পাতা বা ফুল না ছেঁড়েন বা অকারণে গাছের ডাল না ভাঙ্গেন।
মা সব সময় কাজ নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। দিনরাত শুধু কাজ আর কাজ। কাজই যেন ছিল
তাঁর জীবন । আজীবন তিনি কামনাহীন কর্মযজ্ঞ করে গেছেন ।
মা শুধু একজন জ্ঞানতপস্বিনী বা রুক্ষ যোগিনীই ছিলেন না। তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড সৌন্দর্যবোধও ছিল । এক নিবিড় সৌন্দর্যবোধের দ্বারা তিনি বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে চমৎকার সামঞ্জস্য সাধন করে চলতেন । তিনি চাইতেন মানুষের অন্তঃপ্রকৃতিও এমনি বাইরের প্রকৃতির মতো সুন্দর হয়ে উঠুক । এভাবে তিনি আশ্রমটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমিরূপে গড়ে তুলেছিলেন ।
মায়ের এক অভাবনীয় পরিকল্পনা ছিল শ্রীঅরবিন্দের নামে অরোভিল নগর প্রতিষ্ঠা । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ পরিকল্পনা করেছিলেন । এর জন্য পণ্ডিচেরীর উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ছয় মাইল দূরে সমুদ্র উপকূলে ১৫ বর্গমাইল ভূমি সংগ্রহ করা হয় । ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮এ ফেব্রুয়ারি এর ভিত্তিস্থাপন করা হয় । ভিত্তিমূলে পৃথিবীর ১২৬টি দেশের মাটি এনে জড় করা হয়। ঐসব দেশের তরুণ-তরুণীরা এ মাটি নিয়ে আসেন । ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি মায়ের শুভ জন্মদিনে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ।
মায়ের পরিকল্পনা ছিল, অরোভিল হবে একটি আধুনিক নগর। এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক বাস করবে । সবাই হবে এক পরিবারের সদস্য । এখানে আধুনিক নগরের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে । আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দর্শন, আধ্যাত্মিক সাধনা সব কিছুর চর্চা হবে এখানে। অরোভিল হবে সমগ্র বিশ্বমানবের । আন্তর্জাতিক মানব-ঐক্যের জীবন্ত ল্যাবরেটরি । এটি হবে একটি আত্মনির্ভরশীল জনপদ । এখানকার সকলেই হবে এর জীবনযাত্রা ও উন্নতির অংশীদার । তারাই নানাভাবে এর সকল কাজ করবে । কাউকে খাজনা দিতে হবে না । কাউকে খাবার ভাবনা ভাবতে কবে না । সকলকে খাওয়াবার দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানই গ্রহণ করবে। সকল দেশেরই আচার-ব্যবহার ও খাদ্যরীতি সম্পূর্ণই বজায় রাখা হবে। অরোভিল হবে সকল প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে একমাত্র সত্যের সেবা ।
মায়ের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী অরোভিল নগর সত্যিই গড়ে উঠেছে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ
শেষ হয়েছে । সেখানকার অধিবাসীরা মায়ের আদর্শকে শিরোধার্য করে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন ।
শ্রীমা সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন । গানও জানতেন । ভালো অর্গান বাজাতে পারতেন । প্রতি বছরের শেষ দিন রাত বারোটার পর তিনি অর্গান বাজিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেন । বিভিন্ন রচনায় তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা ও কবিত্বশক্তিরও পরিচয় পাওয়া যায় ।
মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রম সারা ভারতে এক আদর্শ স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করে । এর আদর্শে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অরবিন্দ আশ্রম গড়ে ওঠে। বাংলাদেশেও অরবিন্দ আশ্রম রয়েছে । এই আশ্রমের আদর্শ ভারতবাসীদের জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে ।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে শ্রীমার জীবনাদর্শ থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হলো: ব্যক্তিজীবনে পবিত্রতা, ঈশ্বরে বিশ্বাস, শিক্ষা ও সেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা । সামগ্রিকভাবে নৈতিক উন্নতি ও মঙ্গল সাধন করা ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১। ভগবানের পূর্ণাবতার কে ?
ক. মৎস্য
খ. বরাহ
গ. নৃসিংহ
ঘ. শ্ৰীকৃষ্ণ
২। চরক সংহিতা কয়টি ভাগে বিভক্ত?
ক. পাঁচ
খ. ছয়
গ. সাত
ঘ. আট
৩। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পৃথিবীতে অবতরণের কারণ হচ্ছে -
i. ধর্মকে সংস্থাপন
ii. দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন
iii. সজ্জনদের বিনাশ
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. i ও ii ঘ. i, ii ও iii
গ. ii ও iii
8। ‘মা গুরুজন, ব্রহ্মময়ী-স্বরূপা'- এটি কার বাণী?
ক. শঙ্করাচার্য
গ. নৃসিংহ
খ. বিজয়কৃষ্ণ ঘ. বিবেকানন্দ
৫৷ লোকনাথ বাবার নির্দেশে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কোথায় আশ্রম স্থাপন করেন?
ক. ঢাকা
খ. বরিশাল
গ. যশোর
ঘ. খুলনা
৬। আমেরিকার সংবাদপত্রসমূহে কাকে ‘সাইক্লোনিক হিন্দু' নামে অভিহিত করা হয়?
ক. প্রভু নিত্যানন্দ
খ. স্বামী বিবেকানন্দ
গ. শ্রীরামকৃষ্ণ
ঘ. শ্রীঅরবিন্দ
সৃজনশীল প্রশ্ন :
১ । তমা লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন সকালে বাড়ির উঠানের একপাশে পাখিদের জন্য খাবার দিয়ে রাখে । পাখিরাও নিয়মিত এসে খেয়ে যায় । এতে সে পরম আনন্দ লাভ করে । হঠাৎ তমার বাবা তমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করলে তমা তীব্র প্রতিবাদ জানায় । অবশেষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের হস্তক্ষেপে তমার অধিকার রক্ষা পায় ।
ক. বিবেকানন্দ ‘বেদান্ত সমিতি' নামে একটি সংগঠন কোথায় স্থাপন করেন?
খ. শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি বিবেকানন্দের ভক্তিভাব গড়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা কর ।
গ. অনুচ্ছেদে তমার পাখিপ্রীতি স্বামী বিবেকানন্দের কোন মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত? তোমার
পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. স্বামী বিবেকানন্দের কোন আদর্শ তমার শিক্ষকের চরিত্রে এবং কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে
তা মূল্যায়ন কর।
২। ধর্মবিষয়ক শিক্ষক দীনেশচন্দ্র নবম শ্রেণিতে আদর্শ জীবনচরিত অধ্যায়ের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে এমন একজনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন, যিনি ইউরোপীয় বেশভূষা ত্যাগ করে একজন জ্ঞান তপস্বিনীর বেশ ধারণ করেন এবং একটি আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আশ্রমটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে ওঠে। এমনকি তার সৌন্দর্যবোধ ও অভাবনীয় পরিকল্পনায় একটি নগরও গড়ে ওঠে ।
ক. শ্রীবিজয় কৃষ্ণের পিতার নাম কী?
খ. বিজয়কৃষ্ণ কেন ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন?
গ. অনুচ্ছেদে ধর্মীয় শিক্ষক যে সাধক-সাধিকার কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন তাঁর সাধনজীবন তোমার
পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. নগর প্রতিষ্ঠায় উক্ত সাধক-সাধিকার অবদান মূল্যায়ন কর।
সমাপ্ত
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান শ্রীকান্তের সাথে রুপাদেবীর বিয়ে হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির ধন-সম্পদের প্রতি তার কোনো আসক্তি নেই। সে সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের কীর্তন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এক পর্যায়ে সে সংসারধর্ম ত্যাগ করে কৃষ্ণনাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করে।
“শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্ৰীকৃষ্ণ, সারথি, রথী, অর্জুন, ভক্ত, সখা, রথ, পরমেশ্বর।”
এক ঈশ্বরের শরণ নেই আমরা বিভিন্নভাবে। রামকৃষ্ণ দেব তাই বলেছেন ‘যত মত, তত পথ'। তিনি ধর্মীয় বিভেদ ভুলে ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার কথা বলেছেন।
Read more